ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||  আশ্বিন ১ ১৪৩১

ড. ইউনূসের নেতৃত্বেই নতুন সরকার

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১০:৫৬, ৭ আগস্ট ২০২৪  

ড. ইউনূসের নেতৃত্বেই নতুন সরকার

ড. ইউনূসের নেতৃত্বেই নতুন সরকার

নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিদলের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ সময় তিন বাহিনীর প্রধানরা উপস্থিত ছিলেন। গতকাল মঙ্গলবার রাতে বৈঠক শেষে এ সিদ্ধান্তের বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব জয়নাল আবেদীন।নতুন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে ১০ থেকে ১৫ জনের নাম প্রস্তাব করেছে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম জানিয়েছেন, সবার সঙ্গে আলোচনা করে বাকি উপদেষ্টাদের নাম চূড়ান্ত করা হবে।ছাত্র-জনতার প্রবল বিক্ষোভের মুখে সোমবার বেলা ৩টার দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে জানান সেনাপ্রধান। দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠন করা হবে বলেও জানান তিনি। এরপরই দেশের সর্বমহলে এ নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গতকাল বেলা ৩টার মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে দাবি জানায়। একই সঙ্গে তারা সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. ইউনূসের নাম প্রস্তাব করে। রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকেও দ্রুত সরকার গঠনের দাবি ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিকেলেই সংসদ ভেঙে দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। এরপরই রাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের রূপরেখা নিয়ে বৈঠক শুরু হয়।

এর আগে সরকারের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা করতে সন্ধ্যায় বৈঠক করতে বঙ্গভবনে যায় ছাত্র আন্দোলনের ১৩ সদস্যের একটি দল। এরপর যান তিন বাহিনীর প্রধানরা। এ ছাড়া বঙ্গভবনে যান বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশেনর (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য এ কে আজাদ। বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীমউদ্দীন।

বৈঠকে সরকারের প্রধান কে হবেন? অন্য কারা কোন কোন দায়িত্ব পালন করবেন সে বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। এ সরকারের প্রধান হিসেবে ছাত্র আন্দোলনের নেতারা নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম প্রস্তাবের পর তিনি রাজি হয়েছেন বলে জার্মানভিত্তিক একটি গণমাধ্যম জানায়। তাকে প্রধান করে ১০ সদস্যের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঘোষণা করা হতে পারে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।

সমন্বয়কদের ব্রিফিং : রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠক শেষে বেরিয়ে বঙ্গভবনের ফটকে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে পড়েন বৈষ্যমবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা। এ সময় তাদের সঙ্গে থাকা অধ্যাপক আসিফ নজরুল জানান, সমন্বয়কদের পক্ষ থেকে নাহিদ ইসলাম বৈঠকের সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানাবেন। পরে নাহিদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি ও তিন বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে আমরা দীর্ঘ সময় আলোচনা করেছি। অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্য হিসেবে আন্দোলনকারী ছাত্রদের পক্ষ থেকে যে নাম প্রস্তাব করা হবে, তা মেনে নেওয়া হবে বলে নিশ্চয়তা পেয়েছি। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে আমাদের পক্ষ থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম প্রস্তাব করা হলে রাষ্ট্রপতি তাতে সম্মতি দেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্য হিসেবে আমরা প্রাথমিকভাবে ১০-১৫ জনের নামের একটি তালিকা রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে এসেছি। যেখান থেকে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুতই নাম চূড়ান্ত করা হবে। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আপনারা চূড়ান্ত তালিকার ঘোষণা পেয়ে যাবেন।’

সরকারি স্থাপনা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষা এবং সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ঠেকাতে শিক্ষার্থীরাসহ সব নাগরিককে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ বাহিনীর পুনর্গঠনের দাবি জানান ছাত্র আন্দোলনের এ সমন্বয়ক।

অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদকাল কতদিন হবে জানতে চাইলে নাহিদ ইসলাম বলেন, বর্তমানে বিদেশে থাকা ড. ইউনূস দেশে আসার পর সবার সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবেন।

ড. ইউনূস কবে দেশে ফিরবেন জানতে চাইলে নাহিদ বলেন, ‘উনার (ড. ইউনূস) একটি মাইল্ড অপারেশন (ছোট অস্ত্রোপচার) হয়েছে। উনি কাল (আজ) রাতের মধ্যে না হলেও পরশু (আগামীকাল) সকালের মধ্যে দেশে এসে পৌঁছবেন ইনশাআল্লাহ।’

গতকাল ভোরেই আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সর্বজন গ্রহণযোগ্য আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গেও আমাদের কথা হয়েছে। ছাত্র জনতার আহ্বানে বাংলাদেশকে রক্ষা করতে এই গুরুদায়িত্ব নিতে সম্মত হয়েছেন।’ ছাত্র নাগরিকের সমর্থিত সরকার ছাড়া সামরিক কিংবা অন্য কোনো ধরনের সরকারকে তারা সমর্থন দেবেন না।

বাংলাদেশের সংবিধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিষয়ে কিছু বলা নেই। আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে বিধান ছিল, সেটিও ২০১১ সালে বাতিল করা হয়েছে। তাহলে এই সরকার গঠিত হবে কীভাবে? নতুন এই সরকার গঠিত হলে তার আইনি প্রক্রিয়াইবা কী হবে? গণরোষের মুখে সোমবার ক্ষমতা ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়া আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি পদত্যাগ করায় মন্ত্রিসভাও ভেঙে গেছে। ফলে দেশ পরিচালনার জন্য যে ধরনের সাংবিধানিক সরকার কাঠামো দরকার হয়, সেটি এখন নেই। এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত অন্তর্বর্তীকালীন একটি সরকার গঠনের তাগিদ ছিল রাজনৈতিক দলগুলো।

গতকাল সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাগিদ দিয়ে বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির কাছে আহ্বান জানাচ্ছি, কালবিলম্ব না করে আজকের মধ্যেই পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন করুন। অন্যথায় দেশে আবার রাজনৈতিক শূন্যতা দেখা দিতে পারে।’

গত সোমবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ঘোষণা দেন রাষ্ট্রপতি। ওইদিন বিকেলে বঙ্গভবনে তিন বাহিনীর প্রধানদের উপস্থিতিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিষয়ে সংবিধানে কিছু উল্লেখ নেই। তবে কাছাকাছি ধরনের একটি ব্যবস্থার কথা আগে বলা ছিল, যেটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নামে পরিচিত। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান ও ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। পরে এ পদ্ধতি অনুসরণ করেই তিনটি নির্বাচন হয়। কিন্তু ২০১১ সালে এ ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধান সংশোধন করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ক্ষমতায় থাকা সরকারের অধীনেই জাতীয় নির্বাচন হবে। এরপর ওই সরকারই বিজয়ী রাজনৈতিক দল বা জোটের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। কিন্তু নির্বাচন ছাড়াই হুট করে সরকারের পতন ঘটায় বর্তমানে দেশে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেটি বিবেচনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের দাবি উঠেছে।

সংবিধানের ৭২ অনুচ্ছেদে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর লিখিত পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সংসদের অধিবেশন আহ্বান, সমাপ্তি এবং সংসদ বিলুপ্তি করবেন।’

সংবিধানের ৭২ অনুচ্ছেদের এক নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘সরকারি বিজ্ঞপ্তি দ্বারা রাষ্ট্রপতি সংসদ আহ্বান, স্থগিত ও ভঙ্গ করিবেন। তবে আরও শর্ত থাকে যে, এই দফার অধীন তাহার দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক লিখিতভাবে প্রদত্ত পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন।’

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর গৃহীত সামরিক শাসনের সব কর্মকাণ্ডকে ১৯৭৯ সালে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। একইভাবে ১৯৮৮ সালে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল আরেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ডকে। যদিও সামরিক শাসনের বৈধতা দেওয়ার পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীকে ২০১০ সালে অবৈধ ঘোষণা করে উচ্চ আদালত। গণঅভ্যুত্থানে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর জেনারেল এরশাদ সরকারের পতনের পর পঞ্চম সংসদের নির্বাচন পরিচালনার জন্য তিন মাসের অন্তর্বর্তীকালীন বা অস্থায়ী একটি সরকার গঠন করা হয়েছিল। সে সময় আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিসহ আন্দোলনকারী সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে সেই অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়েছিল। সেজন্য বিচারপতি আহমদকে প্রথমে উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং এরপর তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর নির্বাচন শেষে প্রধান বিচারপতির পদে ফিরে যান। এ দুটি বিষয়ে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল সংবিধানের একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। ১৯৯১ সালে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত পঞ্চম সংসদে এ সংশোধনী পাস করা হয়।

দ্বাদশ সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে গতকাল তিন বাহিনীর প্রধান, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সঙ্গে বৈঠকের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদীন গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানান।

গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। ওই নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ নৌকা প্রতীকে ২২২টি আসন পায়। বিরোধী দল জাতীয় পার্টি পায় ১১টি আসন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পেয়েছিলেন ৬২ আসন। ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও কল্যাণ পার্টি একটি করে আসন পায়। এরপর ১১ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। প্রায় সাত মাসের মাথায় এ সরকারের পতন হলো।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়